পুলিশের এনকাউন্টারে মৃত্যু ভাঙ্গার নাজ-হত্যার আসামি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জেল-ফেরার কুখ্যাত হিফজুরের
শিলচর : পুলিশের এনকাউন্টারে ধরাশায়ী হয়েছে করিমগঞ্জ জেলার বদরপুর থানাধীন ভাঙ্গার বছর ২০-এর আহারার আহমেদ ওরফে নাজ-হত্যার মূল আসামি তথা জেল থেকে পলাতক কুখ্যাত হিফজুর রহমান। আজ মঙ্গলবার ভোরে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ খুনি তথা জেল-ফেরার হিফজুর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
কাছাড়ের পুলিশ সুপার নোমাল মাহাতো এ প্রসঙ্গে জানান, গত ১১ মে শিলচরের কেন্দ্রীয় কারাগারের শৌচাগারের কাছে সীমানা দেওয়ালের নীচে মাটি খুঁড়ে সুরুঙ্গ তৈরি করে আরেক খুনের আসামি দীপ নুনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যায় খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হিফজুর। এর পর থেকে তাকে খোঁজে বের করতে পুলিশের কালোঘাম ছুটে। হিফজুরের সন্ধান বের করতে চতুর্দিকে জাল পাতে অসম পুলিশ। গতকাল রাতে পুলিশের কাছে খবর আসে, একটি ম্যাক্সিক্যাবে চড়ে হিফজুর রহমান মেঘালয় সীমান্ত পার হয়ে কাছাড়ে আসছে।
পুলিশ সুপার জানান, ওই খবরের ওপর ভিত্তি করে গতকাল রাতে অসম-মেঘালয় সীমান্তে সশস্ত্র দল নিয়ে পুলিশের আধিকারিকরা ওত পেতে বসেন। গভীর রাতে তার গাড়ির গতিরোধ করে পুলিশের দল তাকে পাকড়াও করে। তাকে তুলে নেওয়া হয় পুলিশের গাড়িতে। কিন্তু বুরুঙ্গা এলাকায় আসার পর প্রস্রাব করার কথা বলে সে। দুই কনস্টেবলকে সঙ্গে দিয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামানো হয়। কিন্তু নীচে নামার কিছুক্ষণ পর আচমকা সে পুলিশের দুই কনস্টেবলের ওপর পাল্টা হামলা করে পালানোর চেষ্টা করে। তার হামলায় দুই পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। পুলিশ তখন বাধ্য হয়ে তাকে রুখতে গুলি ছুঁড়ে। এতে সে গুলিবিব্ধ হয়ে পড়ে যায় সে।
সঙ্গে সঙ্গে তাকে কালাইনের এফআরইউ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাঁর অবস্থা সংকটজনক বলে রেফার করা হয় শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। নিয়ে আসা হয় শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এখানে নিয়ে আসার পর কর্তব্যরত ডাক্তাররা তার চিকিত্সা শুরু করেন। কিন্তু আজ ভোরের দিকে খুনের আসামি জেল-ফেরার হিফজুর রহমান মৃত্যুবরণ করে, জানান মাহাতো।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ২০ নভেম্বর এআইইউডিএফ-এর করিমগঞ্জ জেলা সভাপতি তথা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী তোফাইল আহমেদের ছেলে কলেজ-ছাত্র আহরার আহমেদ ওরফে নাজ আহমেদ (২০)-কে অপহরণ করেছিল মোটর মেকানিক হিফজুর রহমান। কিন্তু ঘটনার মাস্টারমাইন্ড ছিল সেলিম আহমেদ নামের এক ব্যক্তি। ছেলেকে মুক্তি দিতে ৪০ লক্ষ টাকা পণ দাবি করেছিল সেলিমরা। পরবর্তীতে দর কষাকষি করে মুক্তিপণের মোটা অঙ্কের টাকাও পাঠানো হয়েছিল অপহরণকারীদের কাছে। ইত্যবসরে নাজ আহমেদকে নৃশংসভাবে গুলি করে খুন করা হয়েছিল।
ঘটনাকে কেন্দ্র করে বদরপুরের পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। পাঁচদিন পর গুলিবিদ্ধ নাজের লাশ তার বাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে মনসাঙ্গন এলাকার এক টিলায় মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করে পুলিশ। পরবর্তীতে নাজের বাবা তোফাইল আহমেদকে তাঁর মাথায় গুলি করে খুন করা হয়। এর পর বদরপুরের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। উত্তেজিত জনতা পুড়িয়ে দেন সেলিম ও হিফজুরদের বাসা এবং কয়েকটি দোকানঘর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জেলা প্রশাসন বদরপুরে কারফিউ জারি করেছিল।
ইত্যবসরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই সালে নাজ-খুনের মূল অভিযুক্ত হিফজুর রহমান সহ ১৩ জনকে গোপন আস্তানা থেকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় করিমগঞ্জের জেলা ও দায়রা বিচারপতি কমলেন্দু চৌধুরীর আদালতে। প্রায় এক বছর শুনানির পর গত ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি আদালত হিফজুর সহ ছয়জনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়। এর মধ্যে সেলিম আহমেদ এবং হিফজুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড, দুজনকে যাবজ্জীবন এবং আরও দুজনকে দশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন বিচারপতি কমলেন্দু চৌধুরী।
জেলা আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সেলিম ও হিফজুর গুয়াহাটি উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করে। উচ্চ আদালত তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় বদল করে যাবজ্জীবন কারাবাসের রায় দেয়। এর পর বেশ কিছুদিন পর উভয়কে করিমগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে তাদের স্থানান্তর করা হয় শিলচরের কেন্দ্রীয় কারাগারে।
এদিকে, ১১ মে শিলচরের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হিফজুর রহমানের পালিয়ে যাওয়ার খবরে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় বদরপুরে। বহুজন আতঙ্ক বোধ করছিলেন, এবার বোধহয় প্রতিশোধ নিতে আবারও হামলা চালাতে পারে হিফজুর। কিন্তু আজ তার মৃত্যুর খবর শুনে বদরপুরবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।