অসমিয়া জাতি গঠন প্ৰক্ৰিয়ায় বাঙালিদের ভূমিকা অপরিসীম : মুখ্যমন্ত্ৰী হিমন্তবিশ্ব
ধেমাজি, ৩০ মে : অসমিয়া জাতি গঠন প্ৰক্ৰিয়ায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভূমিকা অপরিসীম, বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা।
আজ মঙ্গলবার ধেমাজির শিলাপথারের ভৈরবপুর নেতাজি সমন্বয় ক্ষেত্ৰে সারা অসম বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশনের পঞ্চদশ দ্বি-বাৰ্ষিক কেন্দ্ৰীয় অধিবেশন এবং ধেমাজি জেলা সমিতির অষ্টম দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনে প্রধান অতিথির ভাষণে মুখ্যমন্ত্ৰী ড. শর্মা বলেন, বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং সামাজিক প্ৰক্ৰিয়ার মধ্য দিয়ে সময়ের গতিতে এগিয়ে বাঙালি সমাজ বৃহত্তর অসমিয়া সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। বৈবাহিক এবং নানা সম্পৰ্কের মাধ্যমে অসমের জাতীয় জীবনের সঙ্গে সেঁটে যাওয়া অসমের বাঙালিরা রাজ্যের পরম্পরাগত এক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছেন।
কৃষ্টি-সংস্কৃতির পাশাপাশি অসমিয়া ভাষা, সাহিত্যের অগ্ৰগামী যাত্ৰায় অমূল্য অবদান রয়েছে বাঙালিদের। অসমিয়াভাষী এবং বাংলাভাষী অসমিয়ার যৌথ প্ৰচেষ্টায় জগতসভায় অসমিয়া জাতি এক শক্তিশালী রূপে প্ৰতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় এমন বহু স্বনামধন্য অসমিয়াভাষী এবং বাংলাভাষী অসমিয়ার নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে, বলেন, মুখ্যমন্ত্ৰী।
তিনি বলেন, বহু অসমিয়া বাংলা ভাষায় সাহিত্য চৰ্চা করে ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্ৰে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। হলিরাম ঢেকিয়াল ফুকন, যজ্ঞরাম খারঘরিয়া ফুকন, যাদুরাম ডেকা বরুয়া, মণিরাম দেওয়ানের মতো মহান ব্যক্তিবর্গ বাংলা পত্ৰিকায় বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। মণিরাম দেওয়ানের নেতৃত্বে অসমে স্বাধীনতার যে সংগ্ৰাম শুরু হয়েছিল, তার অন্যতম সেনানী ছিলেন একজন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী মধু মল্লিক, বলেন ড. শর্মা।
মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, অসম সাহিত্য সভা গঠনে অগ্ৰণী ভূমিকা গ্রহণকারী মহান অসমিয়াদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বাঙালি পণ্ডিত অধ্যাপক মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচাৰ্য বিদ্যাবিনোদ। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনীর আদলে চন্দ্ৰনাথ শৰ্মা, অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী এবং রত্নকান্ত বরকাকতির উদ্যোগে অসম সাহিত্য সম্মেলনের জন্ম হয়েছিল বলেও জানান তিনি। বলেন, অসমিয়া ভাষা যে স্বতন্ত্র ভাষা সে কথা বঙ্গের বিশিষ্ট সাহিত্যিক সিভিলিয়ান রমেশচন্দ্ৰ দত্ত ব্রিটিশ সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন।
হিমন্তবিশ্ব শর্মা আরও বলেন, অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্ৰকে সমৃদ্ধ করতে অসমের বাঙালিরা দেড় শতকের বেশি কালজুড়ে অবদান রেখেছেন। বৈকুণ্ঠবিহারী রায়, অম্বিকাচরণ ঘোষ, মহেন্দ্ৰমোহন মিত্ৰ, গোপলকৃষ্ণ দে, হরকিশোর চৌধুরী, অধ্যাপক লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, রাজমোহন নাথ, বীরেন দত্ত, যোগীরাজ বসু, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ লেখক অসমিয়া সাহিত্যের বিকাশে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্ৰী ড. শর্মা বলেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় অসমিয়া ভাষা প্ৰতিষ্ঠায় মূল বরেণ্য ব্যক্তি ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ড. শ্যামাপ্ৰসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিদ্যালয় স্তরে মাতৃভাষা মাধ্যমে পঠন-পাঠন, বিশেষ করে প্ৰবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তাব গ্ৰহণ করা হয়েছিল। মাধ্যমিকে অসমিয়া মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তির মূল ব্যক্তি ছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ।
তিনি আরও বলেন, রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুরের রচনায় অসমের বিভিন্ন অঞ্চল, নদ-নদী, পাহাড়-পৰ্বত, ফল-ফুল, গাছ-গাছালি প্রভৃতির নামোল্লেখ রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রবীন্দ্ৰনাথের কবিতা অসমে যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী যোগ করেন, অসমের বহু কবির রচনার ভাব ও রূপের মধ্যে রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুরের কাব্যের অনুরণন দেখা যায়।
নেতাজি সুভাষচন্দ্ৰ বসুর অসমের সঙ্গে অতি নিবিড় সম্পৰ্ক ছিল বলে উল্লেখ করে তরুণরাম ফুকন, কৰ্মবীর নবীনচন্দ্ৰ বরদলৈ, দেবেশ্বর শৰ্মা, অমিয়কুমার দাস, রূপকোঁওর জ্যোতিপ্ৰসাদ আগরওয়ালার সঙ্গে কতটা সম্পৰ্ক ছিল সে তার ওপর আলোকপাত করেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ১৯৩৮ সালে লোকপ্ৰিয় গোপীনাথ বরদলৈয়ের নেতৃত্বে অসমে কংগ্ৰেসের মন্ত্ৰিসভা গঠনে সুভাষচন্দ্ৰ বসু গুরুত্বপূৰ্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, অসমিয়া এবং বাঙালি সমাজ সমন্বয়ের মাধ্যমে যাতে কাজ করে, সে জন্য রাজ্য সরকার প্রয়াস চালিয়েছে। সঙ্গে তিনি বলেন, শদিয়ায় বাঙালি তফশিলি জাতির মানুষজনও যেমন জমি কিনতে পারেন, ঠিক একইভাবে বিটিআর-এও তফশিলি জাতিভুক্ত মানুষ ভূমি ত্ৰুয় করতে পারেন। তিনি বাংলাভাষী অসমিয়া সমাজকে বাস্তবের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাভাষী এবং অসমিয়াভাষী মানুষজনকে পরস্পর পরস্পরের হৃদয়ে স্থান দিতেও আহ্লান জানান মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, গত দু-বছর ধরে অসমে বসবাসকারী বাঙালিরা শান্তি ও নিরাপদে আছেন। সরকারি প্রকল্পগুলির মাধ্যমে সকলে সম-অধিকার লাভ করছেন, বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বৃহত্তর অসমকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া প্রভৃতির ক্ষেত্রে বাঙালি সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সারা অসম বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশনকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে আহ্বান জানান মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়া জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাধনায় সমাজকে আলোকিত করে তোলার ওপরও মুখ্যমন্ত্ৰী গুরুত্ব আরোপ করেছেন আজ। অসমের সার্বিক বিকাশে অসমিয়া এবং বাঙালি সমাজকে সমৰ্পিত হওয়ার ডাক দিয়েছেন হিমন্তবিশ্ব শর্মা।
আজকের অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্ৰী ডা. রণোজ পেগু, সাংসদ প্রদান বরুয়া, বিধায়ক ভূবন পেগু, রামকৃষ্ণ ঘোষ, অজয়কুমার রায়, সনোয়াল কছাড়ি স্বশাসিত পরিষদের মুখ্য কাৰ্যনির্বাহী সদস্য টংকেশ্বর সনোয়াল, দেউরি স্বশাসিত পরিষদের মুখ্য কাৰ্যনির্বাহী সদস্য ভৈরব দেউরি, সারা অসম বাঙালি যুব ছাত্ৰ ফেডারেশনের সভাপতি দীপক দে প্ৰমুখ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেছেন।