Barak Valley

করিমগঞ্জের ভারত-বাংলা সীমান্তবর্তী মানিকপুরে নো-ম্যানস ল্যান্ডে মাতৃবন্দনা, ১৬৪ বছর পূর্ণ দুর্গাপূজার

স্নিগ্ধা দাস, করিমগঞ্জ : ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত জেলা সদর শহর করিমগঞ্জ থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরবর্তী বাইপাস পয়েন্টের নিউ করিমগঞ্জ স্টেশনের বিপরীতে জাতীয় সড়কের ওপাশে কাঁটাতার-ঘেঁষা মানিকপুর গ্রাম।

এই সীমান্তে কাঁটাতারের বাইরে দুর্গামন্দিরে পূজিতা হচ্ছেন দেবী দুর্গা। বিগতদিনের মতো এবারও সীমান্তের মানুষ মেতে উঠেছেন শারদোত্‍সবে।

প্রতিবছরের মতো এবারও প্রতিমা নিয়ে আসা হয়েছে এপার থেকে, নিরঞ্জন করা হবে ওপারে। বিএসএফ-এর প্রহরা চৌকিতে নাম নথিভুক্ত করে দেবী দুর্গাকে প্রণাম জানাতে ভক্তরা ছুটে আসেন কাঁটাতারের বাইরে, তাঁরা আবার মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করছেন কাঁটাতারের ভিতরে।

সীমান্ত শহরে অনেক বিগ বাজেটের পুজো অনুষ্ঠিত হলেও এখানে নেই নির্দিষ্ট কোনও বাজেট। সেই সঙ্গে আনন্দেও খামতি নেই সীমান্তবাসীর। এখানকার দেবী দুর্গা খুবই জাগ্রত বলে বিশ্বাস বাসিন্দাদের। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও গ্রামে কোনও বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান থাকলে সর্বপ্রথম মন্দিরেই নেমন্তন্নপত্র দিয়ে আসেন গ্রামবাসীরা।

মানিকপুরবাসীর বিশ্বাস ও ভক্তি এতটাই যে, গ্রামে কোনও বাড়িতে বিপদ হলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ছুটে যান দেবী দুর্গার কাছে। এমনই সব মাহাত্ম্যের কারণে জাগ্রত দেবী দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীর দিনই হাজারো ভক্তের সমাগম ঘটেছে সীমান্তের দুর্গামন্দিরে।

যে এলাকায় মন্দিরটি রয়েছে তা দু-দেশের একেবারে সীমান্তে। প্রায় ১৫০ বছর আগে মন্দির তৈরি করা হলে দেশ ভাগের পরে এই মন্দির বাদ পড়ে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে। মানিকপুরের সর্বজনীন দুর্গাবাড়ি এবং গ্রামের মধ্যে আছে কাঁটাতারের বেড়া। গোটা এলাকাজুড়ে রয়েছে বিএসএফ-এর নজরদারি। আর মন্দিরে যেতে হয় কাঁটাতার পেরিয়ে। ওপারে জকিগঞ্জ (বাংলাদেশে), এপারে করিমগঞ্জের (ভারতের দক্ষিণ অসম) কুশিয়ারা নদী তীরে এমন জায়গায় মানিকপুরের দুর্গামন্দির যা দুই দেশের কারও এক্তিয়ারে পড়ে না। কাঁটাতার পার হয়ে পুজোর দিন শামিল হন মানিকপুরের বাসিন্দারা।

তবে দুর্গাবাড়ি এবং গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও তা কোনও বাধা সৃষ্টি করে না। দেশ ভাগের সীমানা তাঁদের উত্‍সাহে ভাটা আনেনি। প্রতিবারই উত্‍সাহ ও আনন্দ নিয়েই গ্রামবাসীরা মায়ের চরণে অর্ঘ্য প্রদানের আয়োজন করেন, ব্যতিক্রম হচ্ছে না এবারও। ১৬৪ বছর পূর্ণ করে এবারের দুর্গাপূজা ১৫৬ বছরে পদার্পণ করেছে এখানে।

জনশ্রুতি, এখানে জাগ্রত দেবীর অধিষ্ঠান। আয়োজন ছোট হলেও আনন্দ ও উদ্দীপনায় বিন্দুমাত্র খামতি নেই। সুউচ্চ মণ্ডপ বা তেমন একটা আলোর রোশনাই নেই এই পূজায়। এখানকার স্থানীয়দের বসবাস সুপ্রাচীন থাকলে, ভারতীয় মানচিত্রে দেবীর মন্দির সহ স্থানীয় অনেকে বিভক্ত, তবে মা দুর্গার পূজার্চনায় কোনও ত্রুটি নেই। দেবী-মাহাত্ম্যের টানে মানিকপুর, বাকরশাল, জবাইনপুর, সরিষা, চরাকুড়ি, শীতলপাড়া ছাড়া করিমগঞ্জ শহরের ভক্তদের উপস্থিতিতে উত্‍সবের কয়েকদিন লোকে-লোকারণ্য হয়ে ওঠেছে সীমান্ত। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা এসেছেন মায়ের কাছে মানত করতে।

মানিকপুর দুর্গাবাড়ির বিশেষত্ব হল, ষষ্ঠীর দিন দুপুরে ধুমধাম সহকারে আগের বছরের প্রতিমার নিরঞ্জন হয়। মন্দিরের পিছনে কুশিয়ারা নদীতে দশমী তিথিতে শুধু নবপত্রিকা ভাসান তাঁরা। সারা বছর দেবীর প্রতিমা মন্দিরেই বিরাজমান থাকেন এবং নতুন প্রতিমা এক বছর মন্দিরে পূজিতা হন।

জানা যায়, কাঁটাতার দিয়ে সীমান্ত নির্ধারণ করার কাজ শুরু করে দিলে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঐতিহ্যবাহী দেবী মায়ের মন্দির। পর্যায়ক্রমে সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়। দুর্গা মন্দিরের সামনে সীমান্ত গেট থাকলেও তার বিপরীতে বসানো হয় বিএসএফ-এর প্রহরা চৌকি। সীমান্ত এলাকায় অধিক লোকসমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে। মায়ের বোধন আর বহু প্রাচীন মন্দিরে হবে না বলে নীরবে চোখের জল ফেলেন অনেকে। একসময় ঘন জঙ্গলে পরিণত হয় মাতৃমন্দির।

কিন্তু ২০১১ সালে ঘটে যায় এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। পিতৃপক্ষের অবসানের পর থেকে দেবী মায়ের মন্দিরের দিকে কান পাতলে শোনা যায় কাঁসর, ঘণ্টা ও উলুধ্বনির শব্দ। বোধনের ঠিক দুদিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন সীমান্ত-ঘেঁষা মানিকপুর বিএসএফ চৌকির জওয়ানরা। রুষ্ট দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বিএসএফ জওয়ানদের পূজা-অর্চনার আদেশ দিলে সঙ্গে সঙ্গে দেবী-আরাধনার বন্দোবস্ত করেন খোদ বিএসএফ-এর জওয়ানরা। হাসি ফুটে ওঠে তখন নো-ম্যান্স ল্যান্ড সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের মধ্যে। সে-থেকেই স্থানীয়দের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে মায়ের পায়ে অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য আয়োজনে এগিয়ে আসেন বিএসএফ কর্তৃপক্ষ।

এবার সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে বিএসএফ-এর ১৬ নম্বর ব্যাটালিয়ন। পূজার দিনগুলিতে সকাল ৫-টা থেকে রাত ১০ পর্যন্ত সীমান্তের গেট খোলা রাখা হবে। মন্দিরে যাওয়ার জন্য ভক্তদের যেতে দেওয়া হয় সে সময়।

পূজা কমিটির সভাপতি পরিমল মালাকার এবং সম্পাদক চম্পক মালাকার, অপু মালাকার, শিল্পী মালাকার, ঝুমুর মালাকার, পূর্ণিমা মালাকার, শুক্লা মালাকাররা জানান, ঐতিহাসিক মন্দির মানিকপুর দুর্গাবাড়ি। এমন জায়গায় অবস্থান হওয়ায় মন্দিরের গুরুত্ব অনেক বেশি। নির্দিষ্ট কোনও ধরনের বাজেট ছাড়াই সবার স্বতঃস্ফূর্ত দানে মায়ের বাত্‍সরিক পূজাচর্নার আয়োজন করা হয়েছে। শহরের অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বিএসএফ জওয়ানরাও। তাঁরা বলেন, শুধু এই গ্রামের বাসিন্দারাই নন, দুর্গা পূজার আনন্দে মেতেছেন বিএসএফ জওয়ানরাও। তবে তাঁদের দাবি, বহু প্রাচীন মন্দিরকে সংরক্ষণ করার একান্ত প্রয়োজন।

প্রতিবারের মতো এবারও নদীর পাশ দিয়ে সিঙ্গল লাইন ফেন্সিং নির্মাণ করে মায়ের মন্দিরকে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসার দাবি তুলেছেন কমিটির কর্মকর্তারা। দাবি তুলেছেন, এখানে সিঙ্গল লাইন ফেন্সিং নির্মাণ করার। পূজা কমিটির সভাপতি পরিমল মালাকার বলেন, মাতৃমন্দিরকে কাঁটাতারের ভিতরে আনতে হবে। নতুবা বহু প্রাচীন এই মন্দিররের অস্ত্বিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

Show More

Related Articles

Back to top button